লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে গত মৌসুমে আউশের উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টন। এখন দিন যত যাচ্ছে ততই শঙ্কা বাড়ছে মাঠে থাকা আমন নিয়েও। গত বছর ১ কোটি ৪৯ লাখ টন আমন উৎপাদন হলেও এ বছর সার ও সেচ সংকটে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ হয়নি। সেজন্য চলতি মৌসুমে ১৫-২০ লাখ টন আমন উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্য বলছে, দেশের মোট চালের চাহিদার প্রায় ৫৫ শতাংশ আসে বোরো ধান থেকে। বাকি ৪৫ শতাংশ আউশ ও আমন থেকে। এর মধ্যে আমন থেকে আসে ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ ও আউশ থেকে ৬ থেকে ৭ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছর আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫৯ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমি। এখন পর্যন্ত ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান লাগানো হয়েছে।গত আউশ মৌসুমে ৩০ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বাস্তবে তা ২৫ লাখ টনের বেশি হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে আউশ আবাদ ছিল প্রায় সাড়ে ১১ লাখ হেক্টরের মতো। এ বছর তা প্রায় এক লাখ হেক্টর কমেছে। ফলনও কমেছে খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কমবে। যদিও আউশ উৎপাদনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি।এ বিষয়ে বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা হলো দীর্ঘ খড়ায় সেচ ব্যাহত হয়েছে। সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাষাবাদে খরচ বেড়ে সংকট তৈরি করেছে, যা আমনের সার্বিক উৎপাদনকে ব্যাহত করবে।এ কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, উৎপাদন খরচ যখন বাড়ে তখন কৃষক উপকরণ সঠিকভাবে দিতে পারে না। এ কারণে ফলন কমে। দ্বিতীয়ত, এবার আমন রোপণ বিলম্ব হয়েছে, সেটাও ফলন কমার বড় কারণ।তিনি বলেন, চলতি বছর ১০ শতাংশ জমিতে আবাদ কমবে। উৎপাদনও কমবে সেই হারে। তাতে মনে হয়, ১৫-২০ লাখ টন উৎপাদন কমবে। অর্থাৎ সার্বিক উৎপাদন ১ কোটি ৩৫ লাখ টনের বেশি হবে না। যদিও সরকারের বিভিন্ন মহল দাবি করছে, আমনের উৎপাদন ব্যাহত হবে না। বরং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে। এরই মধ্যে আমন আবাদের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। বাকিটা আগামী সপ্তাহের মধ্যে পূরণ হবে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক হাবিবুর রহমান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বন্যার কারণে কিছু এলাকায় দেরিতে ধান রোপণ চলছে। কিছুদিনের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন চাষের মৌসুম হলেও আগস্টের শেষ পর্যন্ত আবাদ করা যাবে। নির্ধারিত সময়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। সে কারণে উৎপাদন মৌসুম কমার সম্ভাবনা নেই। উৎপাদন বাড়াতে বৃষ্টির পানির বিকল্প হিসেবে বৈদ্যুতিক মোটর, শ্যালো মেশিন, বিএডিসি সেচ প্রকল্প, গভীর নলকূপ ও বরেন্দ্র সেচপ্রকল্পের মাধ্যমে আমন রোপণের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সারের সংকট রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে সেচ খরচ। যদিও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের মতো মাঠের কৃষকদেরও মুখে শঙ্কার কথা। দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁয় অনাবৃষ্টিতে বিলম্ব হয়েছে আমন চাষাবাদ। ফলে চাষিরা সম্পূরক সেচের মাধ্যমে আমনের আবাদ করেছেন। তাতে আবাদ না কমলেও বিলম্ব রোপণের কারণে সেখানে উৎপাদন কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।ফেনী সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক ময়নুল ইসলাম বলেন, দুই বিঘা জমিতে আমনের ধান রোপণ করেছি। বৃষ্টি না হওয়ায় শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে আমন রোপণ করেছি। এখন পর্যন্ত শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে আবাদ করতে হচ্ছে। তবে, দেরিতে লাগানো ও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ফলন কম হবে।ফেনীর পরশুরামের বীরচন্দ্রনগর এলাকার কৃষক এবাদুল করিম বলেন, মৌসুমের শুরুতে রোপণের সময় এবং মধ্যবর্তী সময়ের আগে বেশকিছু সার প্রয়োগ করতাম, যা এ বছর ঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক বস্তা ইউরিয়া ও টিএসপি সারের জন্য আগের চেয়ে সাড়ে ৮০০ টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। প্রতিবার সেচ দিতে বিঘাপ্রতি তেলের খরচ বেড়েছে ৪৫০ টাকা। এত খরচের পর মৌসুম শেষে রোগবালাই থেকে টিকে উঠে ঠিকভাবে ফসল ঘরে তোলা নিয়েও শঙ্কা।