যশোরের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী মঞ্চ আধুনিক বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন উপলক্ষে যশোর ইনস্টিটিউটের আয়োজনে শুক্রবার সন্ধ্যায় নাট্যকলা সংসদের পরিবেশনায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ওপর আসাদুল ইসলাম রচিত নাটক “২৮৮ দিন” মঞ্চায়ন হয়। যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ও নাট্যকলা সংসদের সভাপতি ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ লিটুর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি মোবাইল ফোনে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর যশোরের মানুষের আজ আনন্দের দিন। দীর্ঘ ৯৫ বছর পর আবারও এই বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ চালু হলো। তিনি আরও বলেন, যশোরের জেলা প্রশাসকসহ যশোর ইনস্টিটিউট ও নাট্যকলা সংসদের সকলের প্রচেষ্টায় আজ রঙ্গমঞ্চ উদ্বোধন সফল হয়েছে। বিশেষ অতিথি যশোরের জেলা প্রশাসক ও যশোর ইনস্টিটিউটের সভাপতি মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ঐতিহ্যের জেলা যশোরের মধ্যে প্রাচীনতম যশোর ইনস্টিটিউট বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। আজ সকলের প্রচেষ্টায় নতুন করে রঙ্গমঞ্চ শুরু করতে পেরে গর্বিত। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ওপর রচিত নাটক-‘‘২৮৮ দিন’’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন করতে পেরে আমি ধন্য মনে করছি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন নাট্যকলা সংসদের নাট্য সম্পাদক অ্যাড. চুন্নু সিদ্দিকী। একই মঞ্চে নাট্য ব্যক্তিত্ব নজরুল ইসলাম, পরিবেশ ব্যক্তিত্ব শেখ আশিক মাহমুদ (সবুজ) ও তার প্রতিষ্ঠান গ্রীন ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে যশোর ইনস্টিটিউট নাট্যকলা সংসদ পরিবেশিত নাটক বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ওপর “২৮৮ দিন” মঞ্চায়ন করা হয়। নাটকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেন বঙ্গবন্ধু-আব্দুল আফ্ফান ভিক্টর, ইয়াহিয়া খান-জাহাঙ্গীর হোসেন খোকন, টিক্কা খান-সাজেদুর রহমান, জেলর শাহিনা ইসলাম বিশাল, আমির তাহেরী-সোহানুর রহমান সোহাগ। উক্ত নাটকে সর্বমোট ৩১জন বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। হলভর্তি শ্রোতা দর্শক এই ঐতিহাসিক নাটকটি উপভোগ করেন।
যশোরের বি.সরকার (বিশ্বেশর সরকার) ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ বা বি. সরকার মেমোরিয়াল হল শুধুমাত্র একটি নাম বা প্রতিষ্ঠান নয়। এর আছে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য। যা আজও অনেকের কাছে অজানা। মানুষ শুধু জানতো বি. সরকার মেমোরিয়াল হল হলো একটি বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য চলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও নাট্য সংসদে মঞ্চস্থ হয় নাটকসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু না, এর প্রাচীন ইতিহাস অনেক। আজ থেকে দীর্ঘ ৯৫ বছর আগে ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ। বি. সরকার এর পুরো নাম বিশ্বেশর সরকার।
বৃহত্তর যশোর জেলার তৎকালীন নড়াইল মহকুমার লোহাগড়ার বিখ্যাত মজুমদার পরিবারের কৃতী সন্তান জনবান্ধব ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার এর উদ্যোগে যশোরের ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাবের সাথে নিউ আর্য থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত করা হয় ১৯১৯ সালে। এর ঠিক ৩ বছর পর ১৯২১ সালে আর্য থিয়েটারের সাথে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ নাটকের জন্য নির্মিত হয়। তখন এর নামকরণ করা হয় বি. সরকার (বিশ্বেশর সরকার) মেমোরিয়াল হল। কালের আবর্তে ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এটি একটি সিনেমা হলে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন তসবির মহল সিনেমা হল পরিচয়ের আড়ালে শতবর্ষী এ স্থাপনার গুরুত্ব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রায় হারাতে বসেছিল যশোরবাসী। মুছে যাওয়া গৌরবকে পুনরুদ্ধারে ইজারাদারদের কবল থেকে স্থাপনাটি উদ্ধার করে সংস্কার অর্থাৎ আধুনিকায়ন করেছে যশোর ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। এখানে বলা দরকার যশোর ইনস্টিটিউট এর পরিচালনা পরিষদে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিয়ম বা গঠনতন্ত্রে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন যশোরের জেলা প্রশাসক। বর্তমান যশোরের জনবান্ধব জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান যশোর উন্নয়নের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এই বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। জনবান্ধব ও সাংস্কৃতিকমনা যশোরের জেলা প্রশাসক ও যশোর ইনস্টিটিউটের সভাপতি মো. তমিজুল ইসলাম খান বি. সরকার ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ও হল সংস্কারের জন্য অনুদান দিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। প্রায় ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সবকিছু সংস্কার করা হয়েছে।
বি. সরকার (বিশ্বেশর সরকার) এর আদিনিবাস যশোরের চৌগাছার হাকিমপুর ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামে। কোলকাতার বিখ্যাত গিনি হাউজের স্বত্বাধিকারী বিশ্বেশর সরকার এই হল নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করেন। উল্লেখ্য যে, বি.সরকার ছিলেন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। সেই সূত্রে তাঁর এক ছেলেকে তৎকালীন লন্ডনে পাঠান স্বর্ণের গহনার ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ এর জন্য। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বি.সরকার বিনিময় সূত্রে ভারতের কোলকাতায় চলে যান স্ব-পরিবারে। আজ তিনি অতীত। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া যশোরের স্মৃতি আজও জ্বল জ্বল করছে। তাঁদের এই স্বর্ণের ব্যবসা ভারতের কোলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান রয়েছে।
তৎকালীন পূর্ব বাংলায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বি.সরকার ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ৩টি প্রতিষ্ঠানের সাথে ১৯২৮ সালে একীভূত করা হয়। এগুলো হলো যশোর টাউন ক্লাব, যশোর আর্য থিয়েটার ও যশোর ইনস্টিটিউট। ১৯২৮ সালে এ থিয়েটার নাট্যকলা সংসদ নামে যশোর ইনস্টিটিউটের সাথে একীভূত করা হয়। উপমহাদেশের নাট্য আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে শতবর্ষের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এ প্রতিষ্ঠান। বি. সরকার রঙ্গমঞ্চে ৩টি নাটক সেট করে একই সাথে মঞ্চস্থ করা যায়। বি.সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ নাটকের জন্য নির্মিত হলে এর নাম রাখা হয় বি. সরকার মেমোরিয়াল হল।