“বর্তমানে সিনেমা হলে দর্শক ফিরতে শুরু করেছে।সম্প্রতি বেশ কিছু সিনেমা ভালো যাচ্ছে বলেই বলছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।কিন্তু ইদানিং কালে ইউটিউবে শিল্পীদের বেফাঁস কথাবার্তা,এফডিসিতে ইউটিউবারদের অবাধ যাতায়াত, দর্শকদের কাছাকাছি শিল্পীদের যাওয়া এসব চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কতটা হুমকির? এর প্রভাব কি চলচ্চিত্র শিল্পে পড়ছে? চলচ্চিত্র শিল্পের নানান সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের সাথে কথা বলেছেন – রিয়েল তন্ময়”
কেমন আছেন…?
– আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। বর্তমানে ভালো থাকার কথা। আমাদের চলচ্চিত্র অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভালো ভালো সিনেমা আসছে, দর্শক হলে ফিরেছে। সব কিছু দেখে বেশ ভালো লাগছে।
ফেসবুক ইউটিউবে এক শ্রেণীর শিল্পীদের বেফাঁস কথাবার্তা, চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কতটা হুমকির…?
– অবশ্যই সেটা চলচ্চিত্রের শিল্পের জন্য হুমকির ও ক্ষতিকর। আমার মতে ইউটিউবে যে ভাবে সবাই বলতেছে বলার চেষ্টা করতেছে, ইউটিউব একটা পাইলেই সবাই বলার চেষ্টা করে। কি বলতেছে। কেন বলতেছে। সেটা কোথায় কি করছে এগুলা না বুঝেই কিন্তু সবাই বলতেছে। আর যারা ইউটিউবার তারা খোচাইয়া খোচাইয়া এমন এমন কথা বের করতেছে। এমন এমন কথা বলাচ্ছে সে বলানোতে কিন্তু আসলে আমাদের শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে বেশি কারন ইউটিউবে যদি আমি আর্টিস্টকে অহরহ দেখতে পারি তাহলে আমি সিনেমা হলে কেন যাব। সিনেমা হলে যেয়ে তার ছবি দেখব না তার কথা শুনব না। তার প্রতি যে আমার ভালো লাগা সেটা থাকবে না । এই যে মানুষ কথায় বলে কাছে থাকলে যে ভালোবাসা থাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসা থাকে কিন্তু দূরে থাকলে। তাইলে আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়া উচিত। যখন আমরা একেবারে দর্শকের কাছে চলে যাব তখন কিন্তু দর্শক আমাদের প্রতি সেই ভালোবাসা টা ফিল করবে না। যখন আমি তাদের থেকে দূরে থাকব তখন আমার প্রতি তাদের আকর্ষণটা বেশি থাকবে। যেমন লোকটা জানি কেমন।আমি যা কল্পনা করছি লোকটা কি এমন হবে। ভালো কথা বলবে।এই জিনিস গুলো আসলে আমরা মিস করছি।
এক শ্রেণীর শিল্পীদের ইউটিউবে কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি বিষয়ে কি বলবেন …?
– কিছু কিছু ইউটিউবার আছে যারা এগুলা করছে। তারা একটা কন্টেন্ট বানাচ্ছে বানিয়ে নিজেরাই কমেন্টস করছে। মানে তারা ক্যাপশন দিচ্ছে একরকম আর সেখানে অন্যরকম ভাবে কথা বলছে। এব্যাপারগুলো খবই লজ্জাজনক ও খুবই ঘৃনিত। কারন কাউকে নিয়েই কোন কথা এভাবে বলা উচিত না। যেমন কিছু কিছু জিনিস অমুক আর্টিস্টের পেমেন্ট কত, তমুক আর্টিস্ট কত টাকা নিচ্ছে। অমুক আর্টিস্টের ভাই এরকম ছিল, তমুক আর্টিস্টের বোন এরকম ছিল, অমুক আর্টিস্ট রাস্তা থেকে উঠে এসেছে। এরকম বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তারাই তৈরি করছে। এটা খুবই খারাপ ।আমি ইউটিউবারদের অনুরোধ করব আপনারা ভালো কিছু করেন।ভালো কিছু দিয়ে আপনারা আপনাদের ইউটিউবে লাভবান বেশি হতে পারবেন, সেগুলা করেন। কাউকে বিক্রি করে এই যেমন শিল্পী বলেন আমাদের টেকনিশিয়ান বলেন পরিচ্চালক বলেন প্রযোজক বলেন এই যে তাদের বিক্রি করে তাদের নামে উলটাপালটা কথা বলে ভিডিও বানাচ্ছেন এগুলা যেন না করেন আপনারা। আপনার উদ্দেশ্যে আমার এটাই বার্তা রইল।
এব্যাপারে শিল্পীদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন…?
– আর শিল্পীদের তো আমরা বারণ করেছি। যেমন যারা বলার কথা না তারাও এখন বক্তব্য দিচ্ছে। ইউটিউবারও কিন্তু তাদের কাছ থেকে বক্তব্য নিচ্ছে।সামনে পাচ্ছে একটা বক্তব্য নিয়ে নিলো। এই বক্তব্য গুলো ক্ষতি করছে। আমরা এযাবতকালে সকল সংগঠন মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে ইউটিউবে আমরা কেউ বক্তব্য দিতে পারব না। যদি দিতেই হয় আমাদের আহ্বায়ক আছে আলমগীর ভাই তিনি এটা বলেছেন যে সবার ক্ষত্রেই যেন এটা হয়। কেউ যেন অতিরিক্ত উল্টাপাল্টা বক্তব্য না দেয়। আমরা এমডিকেও এটা জানিয়েছি এফডিসিতে যেন ইউটিউবার না ঢুকে । আলমগীর ভাই তো খুবই উত্তেজিত আছে এই ব্যাপারটা নিয়ে। ইউটিউবারদের আসলে আমরা প্রশ্রয় দিতে চাই না। যখন তারা সত্যি সত্যি ভালো কিছু করবে।ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো কিছু করবে। অবশ্যই তাদের তখন আমরা স্বাগতম জানাব। কিছু কিছু হয়তো ভালো কাজ করছে। আবার বেশ কিছু খারাপ কাজ করছে। এই নেতিবাচক কাজ যারা করছে তাদের আমরা এড়িয়ে চলছি, তারা যেন কোন ভাবেই সুযোগ না পায়। ভালোর সাথে আমরা আছি তারাও আমাদের সাথে থাকবে সব সময়।
এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমা ও বাইরের ঘরানার সিনেমা,কোনটি মূলধারার…?
– না না না সিনেমা তো সিনেমাই । এখন যেমন হাওয়া চলছে, পরাণ চলছে, দিন দ্যা ডে চলছে, শান চলছে, গলুই চলছে এগুলা যে সিনেমা রিলিজ হয়েছে এগুলা ভালো যাচ্ছে। এগুলা তো সবই আমাদের সদস্যরাই বানাচ্ছে। তারা হয়তো বাইরে থেকে বানাচ্ছে। কারন এফডিসিতে এখন সে পরিবেশটা সম্পন্ন হয়নি। যার জন্য এখন সব কিছুই বাইরে পাওয়া যায় বাইরে থেকেই কাজ করতে হয়। সবাই আমাদের সদস্য। কিছু কিছু নির্মাতারা এখন নতুন শিল্পীও আনছে। আমরা বলব সবাই ভালো। এবাপ্যারে আমরা কখনোই দুই ভাগ করি না। এটাকে আমরা মনে করি সবাই এক । চলচ্চিত্র মানে যেটা চলমান সেটাই চলচ্চিত্র।
একটি শ্রেণীর লোকজন বলছে টেলিভিশন নির্মাতারা যা বানায় তা নাটক টেলিফিল্ম…?
– না না এগুলা আগে ছিল। অনেক আগে ছিল। তখন সেলুলয়েডের ফিতা কিনতে হত। এক ক্যান ফিল্ম কিনতে হত আমাদের সাড়ে সতেরো হাজার টাকা দিয়ে। যার জন্য তখন কিন্তু ডিরেকশন দেয়া ফিল্ম বানানো অনেক কঠিন ছিল। এখন তো হার্ডড্রাইভে আমাদের চিপসের মাধ্যমে শ্যুট করা যায়। তখন যে ক্যামেরা ব্যবহার হত ফিল্মের জন্য সেটা এক রকম ক্যামেরা ছিল। আর এখন যেটা হচ্ছে, যে ক্যামেরা দিয়ে ফিল্মের শ্যুট হচ্ছে সেইম ক্যামেরা দিয়ে নাটকও শ্যুট হচ্ছে। সুতরাং নাটক আর ফিল্মের মধ্যে যে পার্থ্যক্যটা আগে বলতাম সেই পার্থ্যকটা এখন শুধু অভিনয়ের স্পীডের সাথে চেইঞ্জ হইছে। নাটকে অভিনয়ের স্পীড টা একটু স্লো আর ফিল্মে স্পীড টা একটু বেশী। এছাড়া আর কোন তফাৎ নাই।
দুই ঘরানার সিনেমার ফরম্যাট…?
– ফরম্যাট ও একই। কোন আলাদা কিছু নেই। আর এই বিতর্ক এখন আর নেই। কিছু দিন আগে আমরা বসছিলাম সবাই একসাথে। সেখানে কথা হয়েছে শর্টফিল্ম ,এই ফিল্ম নিয়ে। সেদিন কনভেইনার ছিলেন আমাদের মোরশেদুল ইসলাম সাহেব। তখন উনিই বলেছেন যে আজকে থেকে আমাদের মধ্যে আর কোন পার্থ্যক্য থাকলো না, সেখানে আমাদের চিত্রগ্রাহক সংস্থার প্রেসিডেন্ট ক্যামেরা ম্যান আব্দুল লতিফ বাচ্চুও ছিলেন , এরকম আমাদের যারা ছিলাম এবং তাদেরও অনেকেই ছিলেন । সবাই মিলে একসাথে এই কথাই হল যে এখন থেকে আমরা সবাই নির্মাতা।
গুরুবিদ্যা নাকি লেখাপড়া,সিনেমা বানাতে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ…?
– দুটোই । সিনেমা বানাতে যেমন গুরুবিদ্যা দরকার তেমনি লেখাপড়াও দরকার। সিনেমা বানাতে যেমন আমাকে অনেক পড়তে হবে, জানতে হবে ,শিখতে হবে। আর গুরুর সাথে থেকে আমি তার স্টাইলটাকে ফলো করে তার কাছ থেকে কিছু নিবো। যেটাকে বলে যে সব কিছুরই একটা প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার থাকে , গুরুবিদ্যাটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল , আর লেখাপড়া করে আমি অনেক কিছু জানতে পারব। বিখ্যাত বিখ্যাত পরিচালকরা কিভাবে কাজ করতেন তাদের কর্মগুলো , তাদের কর্মগুলো নিয়ে রিসার্চ করা। একজন ভালো পরিচালক হতে হলে তাকে অবশ্যই দুটো বিষয়েই গুরুত্ব দিতে হবে।
যারা শুধু গুরুবিদ্যা নিয়ে কাজ করে…?
– শুধু গুরুবিদ্যা নিয়ে কাজ করলে তো কাজের কোন ডেভেলপ হবে না। নিজস্ব ব্রেইনের পরেও কিন্তু………আজকে মানুষ বই পড়ে কেন। আজকে মানূষ পেপার পড়ে কেন। টেলিভিশনে খবর দেখে কেন। নতুন কিছু জানতে পারে বলেই তো দেখে। পেপারে যদি প্রতিদিন একই খবর দিত তাহলে কি মানুষ পেপার পড়ত? নতুন নতুন খবর আসতেছে নতুন নতুন খবর জানতেছে। সেজন্যই কিন্তু পেপারটা নিয়ে পড়ে। পেপারে কিন্তু ডিটেইলস দেয়া থাকে টেলিভিশনে কিন্তু ডিটেইলস দেয়া থাকেনা। এজন্যই কিন্তু পেপার পড়া। সেজন্যই আমরা বলি গুরুবিদ্যার পড়ে ডিটেইলস কিছু জানতে হলে বই পড়া দরকার ।
নায়ক নায়িকা হাতের নাগালে…?
– এটার কারন একটাই হচ্ছে যে চলচ্চিত্র হঠাৎ করে অনেক বেশি মাইনাসে চলে গেছিল, চলচ্চিত্রে একটা ক্লান্তিকাল চলছিল, সেই চলচ্চিত্রকে দর্শকদের কাছে আবার নাড়া দেয়ার জন্য দর্শকদের বুঝাইয়া দেয়ার জন্য যে, হুম চলচ্চিত্র কিন্তু আবার হচ্ছে , ভালো ভালো চলচ্চিত্র হচ্ছে। আপনারা সিনেমা হলে আসেন। এই কারনেই কিন্তু টেকশিয়ানরা, শিল্পীরা হলে হলে যাচ্ছেন তাদের ছবি প্রমোশনের জন্য। এটা কিন্তু ওয়ার্ল্ডের অন্য জায়গাতেও হয়। বম্বেতো হয়। ছবির প্রমোশনের জন্য তারা দর্শকদের সামনা সামনি হচ্ছে। এটা আসলে ছবির ব্যবসার জন্য লাভ হচ্ছে কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে ছবির যে দর্শক চাহিদা শিল্পীদের কাছে সেই চাহিদাটা কিন্তু কমে যাচ্ছে। দর্শক যখনি শিল্পীটাকে দেখে ফেলল তারপর ভিতরে যেয়ে তাদের অভিনয়ের যে মজাটা সেটা কিন্তু দর্শক আর পাচ্ছে না। সেজন্য আমরা বলব যে …এটা আস্তে আস্তে কমে যাবে। নতুন নতুন শিল্পীরা যখন পরিচিত হয়ে যাবে দর্শকদের কাছে আর ভালো ভালো ছবি যখন আসতে থাকবে। তখন এটা বন্ধ হয়ে যাবে। আপাতত এটা শুধু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিটাকে চাঙ্গা করার জন্য হচ্ছে।
বর্তমানে যে সিনেমা মুক্তি পেয়েছে বা মুক্তির অপেক্ষায় এগুলো নিয়ে সম্ভাবনা কতটুকু…?
– আমি অনেক বেশি সম্ভাবনা দেখছি। যেটা নিয়ে আমি অনেক বেশি টেনশন করতাম,গত দুই বছর আমি ক্যাবিনেটে আসার পরে এবং তার আগেও ক্যাবিনেটে ছিলাম তবে সভাপতি হিসেবে আসার পরে আমার একটাই চেষ্টা ছিল যে, চলচ্চিত্র শিল্পটাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ রহমতে আমি বলব আমরা আমাদের চেষ্টায় এখন অনেকটাই সার্থক। আমাদের মন্ত্রী মহোদয় জনাম হাসান মাহমুদ সাহেব অনেক বেশি সংবেদশীল । উনি কিন্তু আমাদের এব্যাপারে অনেক বেশী সহযোগিতা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উনি তো আমাদের মানবতার মা। চলচ্চিত্রকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। যার জন্য উনি কিন্তু সব কিছুই করার চেষ্টা করছেন , আমাদের দাবি দাওয়া,আমরা যা চাচ্ছি যেভাবে চাচ্ছি। যেভাবে করলে ভালো হবে।উনি কিন্তু সব কিছুই করছেন। তার ফলেই কিন্তু রেজাল্ট আস্তে আস্তে ভালোর দিকেই যাচ্ছে।
মুক্তির অপেক্ষায় যে সিনেমা আছে সেগুলো নিয়ে কি বলবেন…?
– মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমা নিয়ে… আসলে কয়েকটা ছবিতো আমি সেন্সরে দেখেছি। কিছু ভালো ছবি হবে কিছু একটু ডাউন যাবে। এটা সব সময়। যেমন বছরে আমাদের একশ ছবি রিলিজ হত। কিংবা ৯০ টা ছবি রিলিজ হত তারমধ্যে দেখা গেলো দশ টা ছবি বা ৫ টা ছবি ক্লিক করল হিট সুপার হিট হয়ে গেলো আর কিছু ছবি নরমাল রেঞ্জে গেলো। এটা সব সময়ই হয়ে থাকে। এখনো হবে।
দর্শকদের উদ্দেশ্যে বার্তা…।
– আমার দর্শকদের উদ্দেশ্যে বার্তা এটাই থাকবে যে আপনারা বাংলা ছবি দেখেন । ভিডিও নিয়ে ঘরে বসে ছবি না দেখে সিনেমা হলে এসে ছবি দেখেন। সব ছবি ভালো লাগবে। ছবি দেখার আগ্রহটা বাড়বে। আপনারা একটা নিজস্ব ভাবে চিন্তা করবেন যে ,প্রতি সপ্তাহেই তো ছবি রিলিজ হচ্ছে একটা দুইটা করে । ছবি দেখার জন্য একটা আলাদা বাজেট তৈরি করবেন। আপনারা একসাথে গিয়ে ছবি দেখুন। আপনাদের আনন্দও হবে বেড়ানোও হবে।