অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় সব ধরনের চাপ পড়ছে ভোক্তার কাঁধে। অর্থনৈতিক সংকটে ডলারের সরবরাহ কমায় এর দাম বেড়েছে। ফলে কমেছে টাকার মান। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সঙ্কুচিত হওয়ায় ভোক্তার আয় কমেছে। হ্রাস পেয়েছে সরকারের রাজস্ব আয়। চাপ মোকাবিলা করতে সরকার একের পর এক জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার ও অন্যান্য সেবার মূল্য বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বাড়িয়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। এসবের প্রভাবে প্রায় সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিয়ে সংসার চালানো এখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।সূত্র জানায়, ২০২০ সালের আগে থেকে মন্দার ছাপ ছিল অর্থনীতিতে। ২০২০ সালের মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে এ মন্দা আরও জেঁকে বসে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। এ হিসাবে গত সাড়ে তিন বছর ধরে অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত। ওই সময়ে দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়েনি। ফলে নতুন শিল্প হয়নি বললেই চলে। আগের শিল্পগুলোও টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ফলে তারা কারখানার সম্প্রসারণ করেনি। এতে চাকরির বাজারে দেখা দিয়েছে নিদারুণ মন্দা। গত সাড়ে তিন বছরে যারা কর্মের বাজারে এসেছে তাদের বেশির ভগই এখনো চাকরিতে ঢুকতে পারেনি। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক মোট কর্মের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে, বাকি ৫ শতাংশ সরকারি খাতে। বেসরকারি খাত এখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যস্ত।
ফলে এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের বদলে আরও ছাঁটাই হচ্ছে। কারণ বেসরকারি খাতে সার্বিকভাবে ঋণের প্রবাহ বাড়েনি, বরং কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল ৮.৬৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৭.০৭ শতাংশ। ওই সময়ে ডলারের দাম ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে ১০৮ টাকা হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এ কারণে ডলারের হিসাবে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। বরং তা নেতিবাচক অর্থাৎ আগের চেয়ে কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণের একটি বড় অংশই ডলারে রূপান্তরিত হয়ে আমদানি রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হয়। টাকার হিসাবে আমদানি রপ্তানিতে ঋণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। কিন্তু ডলারের হিসাবে ঋণ বাড়েনি। বরং আগের চেয়ে কমেছে দেড় শতাংশ।বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই এপ্রিলে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪.১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৩৮ শতাংশ। গত কয়েক মাস ধরে রপ্তানি আয়ও কমছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রপ্তানি আয় প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৫০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে রপ্তানি আয় আবার ৫০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। গত এপ্রিলে তা আরও কমে ৪০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। গত জুলাই-মার্চে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৪ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১৬ শতাংশ। রপ্তানির অর্ডার কমেছে ২৫-৩০ শতাংশ। মে মাসে রপ্তানির কাঁচামাল বাবদ ৮০ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য আসতে পারে। জুনে তা আরও কমে ৬৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ রপ্তানিতে আরও মন্দা আসছে। চলমান মন্দায় বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। কর্মীরা বেকার হয়েছে। রপ্তানি আয় কমলেও এ খাতে আরও নেতিবাচক পরিস্থিরি সৃষ্টি হবে।
ডলার সংকটে আমদানি খাত ভুগছে এক বছর ধরে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট প্রকট হয়। তখন থেকে আমিদানিতেও লাগাম টানা হয়। সেপ্টেম্বরে তা আরও কঠোর হয়। এখন উদ্যোক্তাকেই ডলারের সংস্থান করে এলসি খুলতে হয়। ব্যাংক ডলারের জোগান দিতে পারছে না। গত রোজা উপলক্ষ্যে আমদানি কিছুটা বাড়লেও এখন আবার লাগাম টানা হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই মার্চে আমদানি বেড়েছিল ৪৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ১২.৩৩ শতাংশ। এলসি খোলা কমেছে ২৭ শতাংশ।
আগে মাসে এলসি খোলা ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরে তা ৮০০ কোটি ডলারের ঘরে নামে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ৬০০ কোটি ডলারের মধ্যে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আবার কমে ৫০০ কোটি ডলারের ঘরে নামে। নভেম্বরে নেমে যায় ৪০০ কোটি ডলারের ঘরে। ডিসেম্বর থেকে আবার বাড়তে থাকে। মার্চ পর্যন্ত ৫০০ কোটি ডলারের বেশি এলসি খোলা হয়েছে। ওই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি ৫৭ শতাংশ, কাঁচামাল ৩২ শতাংশ, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ৩১ শতাংশ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানি ৪৬ শতাংশ কমেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮.৮৪ শতাংশে উঠেছে। প্রকৃত হিসাবে আরও বেশি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৫.১২ শতাংশ। এদিকে মন্দায় আয় বাড়েনি। গড়ে এপ্রিলে আয় বেড়েছে ৭.২৩ শতাংশ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৬.৫৬ শতাংশ। ওই সময়ে মূল্যস্ফীতির তুলনায় আয় বেড়েছিল বেশি। এখন আয়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। ফলে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ বাধ্য হয়ে চাপ সমাল দিতে খাবারসহ অন্যান্য তালিকা ছোট করছে।
আমদানির চেয়ে রপ্তানি মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ঘাটতি কিছুটা কমানো হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই মার্চে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ২৫০৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে ১৪৬১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।